মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন শুক্রবার ফোনে কথা বলবেন চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের সঙ্গে। এমন মুহূর্তে এই ফোনালাপ অনুষ্ঠিত হচ্ছে যখন ইউক্রেনে রাশিয়ার যুদ্ধকে সমর্থন জানাতে কতদূর পর্যন্ত চীন যেতে পারে তা নির্ধারণের সম্ভাব্য চূড়ান্ত সময় এসেছে বলে মনে করা হচ্ছে।
ইউক্রেনে রুশ হামলা নিয়ে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের প্রস্তাবে ভোটদানে বিরত ছিল চীন। বক্তব্যমূলক অবস্থানে মস্কোর পাশে থাকার বার্তা দিয়েছে বেইজিং। বিশেষ করে ন্যাটোকে রাশিয়ার দোষারোপ ও ষড়যন্ত্র তত্ত্বের কথা দেশটির কণ্ঠেও প্রতিধ্বনিত হয়েছে। বাইডেন প্রশাসন মনে করে, চীন ইতোমধ্যে অর্থনৈতিকভাবে রাশিয়াকে উদ্ধারের সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে।
শুক্রবার শি জিনপিংয়ের সঙ্গে জো বাইডেনের ফোনালাপ অনুষ্ঠিত হবে
সোমবার ইতালির রোমে যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জ্যাক সালিভ্যান ও চীনের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা ইয়াং জিয়েসি বৈঠক করেছেন। সেই বৈঠকে চীনের প্রতিনিধি দল ইউক্রেন ও যুক্তরাষ্ট্র মিলে গোপন জৈব অস্ত্র কর্মসূচি পরিচালনা করছে বলে রাশিয়ার দাবির কথা তুলে ধরেছে। এতে মার্কিন প্রতিনিধি দল হতবাক হয়েছে। মার্কিনিরা অতীতের যেকোনও সময়ের তুলনায় বেইজিংয়ের উদ্দেশ্য সম্পর্কে হতাশা নিয়ে রোম থেকে ফিরেছেন।
এক মার্কিন কর্মকর্তা বলেন, বাণিজ্য, অর্থনৈতিক ও সামরিকভাবে পর্দার অন্তরালে রাশিয়াকে সমর্থনে চীন অনেক কিছু করছে বলে একাধিক ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে। এটি বড় ধরনের উদ্বেগের। চীন যদি এই পথে চলা অব্যাহত রাখে তাহলে তা হবে একটি নির্ধারক টার্নিং পয়েন্ট। যা চীন নিয়ে ইউরোপের উদ্বেগ আরও গভীর করবে। ওয়াশিংটন ও বেইজিংয়ের বিরোধ হবে তীব্র।
কংগ্রেস সদস্যরা সতর্ক করে বলেছেন, যদি ইউক্রেনে রাশিয়ার আক্রমণে চীনের সামরিক সহযোগিতার প্রমাণ থাক তাহলে দেশটির বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। কর্পোরেট নেতারাও ইউরোপীয় সরকারের সঙ্গে মিলে চীনে তাদের বাণিজ্য পর্যালোচনা করতে পারে।
রোমে সালিভ্যানের তুলে ধরা কিছু যুক্তি শি জিনপিংয়ের সঙ্গে ফোনালাপে আবারও হাজির করতে পারেন বাইডেন। সালিভ্যানের যুক্তির মধ্যে ছিল: ইউক্রেনে ভ্লাদিমির পুতিনের উদ্দেশ্য ও সামরিক শক্তি সম্পর্কে ভুল ধারণা পোষণ করছেন শি জিনপিং। বাইডেন যুক্তি তুলে ধরবেন, একটি ভুলকে সমর্থন করা এবং পরাজিতের পাশে থাকা চীনের স্বার্থের পক্ষে মঙ্গলজনক না।
যুক্তরাষ্ট্রের আশঙ্কা, রাশিয়াকে অর্থনৈতিকভাবে সহযোগিতার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে চীন
পৃথক অগ্রগতিতে জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক বিচারিক আদালত বুধবার রাশিয়াকে ইউক্রেনে সামরিক অভিযান স্থগিতের নির্দেশ দিয়েছে। এই নির্দেশের বিরুদ্ধে ভোট দিয়েছেন চীনের বিচারক। কিন্তু জাতিসংঘ চার্টার অনুসারে আইনগতভাবে এই সিদ্ধান্ত মানতে বাধ্য।
পেন্টাগনের সাবেক আইনি পরামর্শক ওনা হাথাওয়ে এবং রায়ান গুডম্যান এক ব্লগে লিখেছেন, ইউক্রেন সংঘাতে রাশিয়াকে সমর্থন করতে হয়ত চীন আগ্রহী। মস্কোকে অস্ত্র সরবরাহের ফলে রাশিয়ার অবৈধ যুদ্ধে সরাসরি যুক্ত হবে চীন এবং এতে দেশটি নিষেধাজ্ঞার ঝুঁকিতে পড়বে।
রোমের চীন-যুক্তরাষ্ট্র বৈঠকের পর বেইজিংয়ের পক্ষ থেকে কিছু ইঙ্গিত পাওয়া গেছে যার ফলে ওয়াশিংটন এখনও মনে করছে সবকিছু ব্যর্থ হয়নি। চীনের রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনে ইউক্রেনের যুদ্ধবিধ্বস্ত শহরের দৃশ্য সম্প্রচার করতে শুরু করেছে। যদিও এখনও এটিকে তারা আক্রমণ বা যুদ্ধ বলছে না। ইউক্রেনে নিযুক্ত চীনা রাষ্ট্রদূত দেশটিকে আশ্বস্ত করেছেন, আমরা সব সময় আপনাদের দেশকে শ্রদ্ধা করব।
জার্মান দৈনিক পত্রিকা বিল্ড এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই ল্যাভরভ বৃহস্পতিবার বেইজিংয়ের পথে ছিলেন। কিন্তু অজ্ঞাত কারণে তিনি মাঝ পথে বিমান ঘুরিয়ে মস্কো ফিরেছেন। যুক্তরাষ্ট্রের একজন কর্মকর্তা বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। তবে সতর্কতার সঙ্গে তিনি জানান, এই মুহূর্তে এই ঘটনার গুরুত্ব কতটা তা বলা মুশকিল। হয়ত চীন সমর্থনের বিষয়টি প্রকাশ্যে আনতে চাইছে না।
১২ মার্চ স্টেট কাউন্সিলের সঙ্গে যুক্ত পলিসি রিসার্চ সেন্টারের ভাইস-চেয়ারম্যান অধ্যাপক হু ওয়েই চীনের ইউক্রেন দ্বিধা নিয়ে একটি নিবন্ধ লিখেছেন। এতে তিনি উল্লেখ করেছেন, পুতিনের সামরিক উদ্যোগ নড়বড়ে হয়ে পড়েছে। পুতিনের সঙ্গে চীনের সম্পর্ক রাখা উচিত না। যত দ্রুত সম্ভব তা বিচ্ছিন্ন করা উচিত।
ভারতের দ্বিধা
ইন্দো-প্রশান্ত অঞ্চলে ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। যুক্তরাষ্ট্র ও জাপানসহ অঞ্চলটির মার্কিন মিত্ররা রাশিয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছেন। কিছু দেশ ইউক্রেনে সামরিক সরঞ্জাম পাঠাচ্ছে।
রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে বিশ্বের দুই শিবিরে বিভক্ত হলে ভারতের জন্য নতুন উভয় সংকট তৈরি করবে। ইউক্রেন ইস্যুতে নিরাপদ দূরত্বে থাকতে চাইছে দিল্লি।
মস্কোকে অস্ত্র সরবরাহের ফলে রাশিয়ার অবৈধ যুদ্ধে সরাসরি যুক্ত হবে চীন
ব্রুকিংস ইন্সটিটিউশনের ভারত প্রকল্পের পরিচালক তানভি মদন বলেন, ভারতের জন্য দেশটির পররাষ্ট্রনীতির উদ্দেশ্য হলো রাশিয়াকে চীনের কাছাকাছি হতে না দেওয়া। ঐতিহাসিকভাবে চীনকে মোকাবিলায় রাশিয়াকে শেষ ভরসা এবং শীর্ষ অস্ত্র সরবরাহকারী হিসেবে দেখে আসছে ভারত।
তানভি মদন বলেন, এমন একটি সংকটে ভারত আশা করছে চীনের পক্ষে ধাবিত হওয়া থেকে বিরত থাকবে রাশিয়া। মস্কো যদি বেইজিংয়ের প্রতি ঘনিষ্ঠ হয় তাহলে চীনের সঙ্গে সংঘাতে ভারতের পক্ষে রুশ সমর্থনের নিশ্চয়তা থাকবে না। রাশিয়ার সামরিক সরবরাহের ওপর অধিক নির্ভরশীলতা কমানোর প্রয়োজনীয়তার বিষয়ের আলোচনাই এখন প্রাধান্য পাচ্ছে।
ইউক্রেন ইস্যুতে চীন রাশিয়ার পক্ষে অবস্থান নিলে ইউরোপকে অর্থনৈতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে হতে পারে।
পূর্ব এশিয়া বিষয়ক সাবেক মার্কিন ডেপুটি অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি আব্রাহাম ডেনমার্ক বলেন, শি জিনপিং ও চীন স্বৈরাচারি ব্লকের শীর্ষ ক্ষমতাধর হিসেবে নিজেদের বিবেচনা করে। ফলে ইউরোপীয় গণতান্ত্রিক দেশের পক্ষে বেইজিংয়ের সঙ্গে সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ করা অসম্ভব। যদি এমনটি ঘটে তাহলে ক্ষমতার ভূরাজনৈতিক ভারসাম্যে নাটকীয় পরিবর্তন নিয়ে আসবে।
সূত্র: দ্য গার্ডিয়ান
Leave a Reply